তাঁর সেই কষ্টের ফসল, ৪৫০ বর্গফুটের টিনশেডের একটি গ্রন্থাগার, যেটি আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা-জীবননগর-দর্শনা জনপদে।
অনেক
কষ্ট আর বাধা ডিঙিয়ে গ্রন্থাগারটিকে যিনি আজও উঁচু শিরে দাঁড় করিয়ে
রেখেছেন; যাঁর কাছে স্ত্রী-সন্তানের চেয়ে বেশি আপনজন এই গ্রন্থাগার, তাঁর
নাম আবু সুফিয়ান (৪৬)।
গ্রন্থাগারটির পোশাকি নাম: দর্শনা গণ-উন্নয়ন গ্রন্থাগার। চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে দর্শনা কলেজপাড়ায় এর অবস্থান।
কোনো পাঠক অসুস্থ হলে আবু সুফিয়ান বই নিয়ে নিজেই হাজির হন তার বাড়িতে।
গ্রন্থাগারের
জন্য বই সংগ্রহের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগঠিত করতে আবু
সুফিয়ানের সুদৃঢ় অবস্থান সর্বজনস্বীকৃত। দেশবরেণ্য অনেকেই বারবার ছুটে
এসেছেন দর্শনায়, আবু সুফিয়ানের বাতিঘরে।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে
গ্রন্থাগারটি আজ রজতজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে। গোটা সময়টাই একটি গৌরবের
ইতিহাস। এই গ্রন্থাগারের সেবার মাধ্যমে অনেক শিক্ষক নিজেকে আদর্শ হিসেবে
গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছেন। শিক্ষার্থীরা পেয়েছে সহশিক্ষায় ভালো ফলের
নিশ্চয়তা। বেকার-শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা নিয়মিত পত্রিকা, জার্নাল ও বই পড়ে
নিজেদের দক্ষ ও চাকরির উপযোগী করে তুলেছেন। শিশু পেয়েছে তার সৃজনশীল
মেধাবিকাশের ঠিকানা। এ গ্রন্থাগারে নিয়মিত উপস্থিতি ও আড্ডার মধ্য দিয়ে
অনেকেই হয়ে উঠেছেন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক।
জন্ম ঠিকুজি: বাবা মরহুম
এসকান্দার আলীর পৈতৃক ভিটা গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার কলপুর গ্রাম। তবে কেরু
অ্যান্ড কোম্পানির বৈদ্যুতিক শাখার কর্মচারী হিসেবে চাকরির সুবাদে দর্শনায়
ছিল বসবাস। ১৯৬৮ সালে সেখানে আবু সুফিয়ানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বাবা-মায়ের বড়
সন্তান আবু সুফিয়ান কেরু উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৮৭ সালে এসএসসি পাস করেন।
ছাত্র ইউনিয়নের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন তিনি। প্রতিকূল অবস্থায় তিনি গোপালগঞ্জ
বঙ্গবন্ধু কলেজে ভর্তি হয়ে সেখান থেকেই উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করে
আবারও ফিরে আসেন দর্শনায়। বইপ্রেমী মানুষটি ভালোবেসে ১৯৯৭ সালে বিয়ে করেন
সহপাঠী সেলিনা আক্তারকে। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। বসবাস দর্শনা
মোবারকপাড়ায়। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া জমিজমার ইজারামূল্য দিয়ে সংসার ও
গ্রন্থাগার দুটোই সমানভাবে চালাচ্ছেন তিনি। পরিবার-পরিজন নিয়ে দিনের পর দিন
অনাহারে-অর্ধাহারে থাকলেও গ্রন্থাগারকে আগলে রেখেছেন আপনের চেয়ে আপন করে।
অবিরাম চলা: গ্রন্থাগারটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা ১৯৯১ সালে হলেও এর বিকাশের পেছনে রয়েছে আত্মত্যাগের অনেক গল্প। সুফিয়ানের বাবা কর্মক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও ছিলেন অভাবনীয় বইপ্রেমী, বিদ্যানুরাগী। বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলেই ছেলের জন্য বই কিনে আনতেন। বাবার উৎসাহে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় নিজে থেকেই বই সংগ্রহ শুরু করেন সুফিয়ান। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে বেশির ভাগ সময় বই কিনতেন। ছাত্রজীবনে সহপাঠী বন্ধুদের নানা ধরনের নেশায় পেয়ে বসলেও তাঁর একমাত্র নেশা ছিল বই। ছাত্রজীবনেই তিনি শতাধিক বইয়ের এক সংগ্রহশালা তৈরি করেন। শোবার ঘরে কোনো তাক না থাকায় চৌকির ওপর বই রেখে বছরের পর বছর মাটিতে শুয়ে দিন কাটিয়েছেন তিনি। গল্প, উপন্যাসের পাশাপাশি সব ধর্মীয় গ্রন্থ, অভিধান, মনীষীদের আত্মজীবনী, মুক্তিযুদ্ধ, ব্যাকরণ, ইতিহাস, বিজ্ঞান, কৃষি এবং বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যবই ছিল তাঁর সংগ্রহে। প্রথম প্রথম সহপাঠীসহ ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বই পড়তে উতসাহিত করতে ধার দিতেন তিনি। পরে পরিচিতজনেরা বই নিয়ে পড়তে শুরু করেন। বইপড়ার প্রতি মানুষের এ আগ্রহ দেখেই গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার চিন্তা তাঁর মাথায় আসে। ১৯৯১ সালে দর্শনা থানাপাড়ায় ছোট একটি টালিঘর ভাড়া নিয়ে গ্রন্থাগারের যাত্রা শুরু। একপর্যায়ে পাশে দাঁড়ায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছু বই সরবরাহের পাশাপাশি প্রতি মাসে মোট খরচের এক-তৃতীয়াংশ দিতে থাকে। তবে ২০০০ সালের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। বিল বাকি থাকায় হকার একদিন পত্রিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেন। সহধর্মিণী সেলিনা বিষয়টি জানতে পেরে সন্তানের দুধের জন্য জমানো টাকা দিয়ে বিল পরিশোধ করেন। আবার দুধের গোয়ালা টাকা না পেয়ে বন্ধ করে দেন দুধ সরবরাহ। দুধের অভাবে সন্তান অভুক্ত থাকলেও জ্ঞানপিপাসু পাঠকদের চাহিদা পূরণে কোনো অবহেলা হয়নি। গ্রন্থাগারের জন্য নেওয়া ঘরের ভাড়া পরিশোধ কিছুটা অনিয়মিত হওয়ায় একপর্যায়ে ঘর ছাড়ার নোটিশ দেন মালিক। এ সময় দর্শনা পৌরসভার চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমানের সহায়তায় গ্রন্থাগার ভবনের জন্য পাঁচ কাঠা খাসজমি বন্দোবস্ত নেওয়া হয়। তবে সেখানে ঘর তোলার মতো কোনো আর্থিক ক্ষমতা ছিল না। স্ত্রী সেলিনা আবারও পাশে এসে দাঁড়ান। তাঁর একমাত্র সম্বল এক জোড়া সোনার বালা অর্ধেক মূল্য ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করে ঘরভাড়ার বকেয়া পরিশোধ ও গ্রন্থাগারের জন্য টিনের ছাউনিসহ ৩০ ফুট লম্বা ১৫ ফুট চওড়া আধাপাকা ঘর তৈরি করা হয়। ১৩ বছর আগে তৈরি এ ঘর এখন অনেকটা জীর্ণশীর্ণ। বৃষ্টি হলেই পানি চুইয়ে ভিজে যায় বই, পাঠকদের বসার জায়গাও হয়ে পড়ে স্যাঁতসেঁতে। অর্থাভাবে উন্নয়ন করা না গেলেও নিয়মিত সংবাদপত্র ও বই সংগ্রহ অব্যাহত রয়েছে।
সরেজমিনে
এক দিন: গ্রন্থাগার নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির জন্য সম্প্রতি সেখানে যাওয়া হয়।
গ্রন্থাগারের ভেতরে-বাইরে অসংখ্য পাঠকের উপস্থিতি। টেবিলে বসে কেউ পত্রিকা,
কেউ বই পড়ায় মগ্ন। আবার অনেকে ঘুরে ঘুরে দেখছেন গোটা চত্বর। ‘পড়তে দাও,
বাঁচতে দাও’—এ রকম স্লোগান লেখা চত্বরে। সেখানে বসে কথা হয় ফরিদপুরের
সাংবাদিক মফিজ ইমামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সমাজের জন্য ভাবার লোক বর্তমানে
খুবই কম। বইয়ের মাধ্যমে সেবা করার এই দৃষ্টান্ত বিরল।’
যশোর এম এম
কলেজের স্নাতকোত্তর-পড়ুয়া দর্শনার মঈনুল ইসলাম শিশু বয়স থেকেই এই
গ্রন্থাগারে আসছেন। বলেন, ‘কলেজ ছুটি দিলে যতটা না বাড়ির টানে, তার চেয়ে এই
গ্রন্থাগারের টানে দর্শনায় আসি।’ দর্শনা কলেজের প্রথম বর্ষের তিন ছাত্রী
ফরিদা ইয়াসমিন, সাবরিনা খাতুন ও শরীফা খাতুন এই গ্রন্থাগারের নিয়মিত পাঠক।
তবে বর্তমান যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে এ গ্রন্থাগারে কয়েকটি কম্পিউটার ও
ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার দাবি তাদের।
ঈদের দিনেও খোলা:
গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ২২ বছরে একটি দিনের জন্যও বন্ধ রাখা
হয়নি। এমনকি ঈদের দিনও নয়। প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত
বিরতিহীনভাবে গ্রন্থাগারটি পাঠকদের জন্য খোলা রাখা হয়। সুফিয়ান ও সেলিনা
পাঠকদের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। প্রতি মাসে অন্তত সাড়ে চার হাজার
থেকে পাঁচ হাজার পাঠক এ গ্রন্থাগারে আসেন। পাঠকদের জন্য আড়াই হাজার বই ছাড়া
প্রথম আলোসহ ১২টি দৈনিক, চারটি সাপ্তাহিক, তিনটি পাক্ষিক, তিনটি মাসিক ও
দুটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা রাখা হয়।
নিজের পৈতৃক কিছু জমির লিজের টাকা, এই
গ্রন্থাগারের সাবেক শিক্ষার্থী, যারা এখন প্রতিষ্ঠিত তাদের যতসামান্য
সহায়তায় ব্যয় মেটান সুফিয়ান।
ইচ্ছার কথা: সুফিয়ান ও
তাঁর স্ত্রী গ্রন্থাগারটিকে নিজেদের আরেক সন্তানের মতো দেখেন। স্ত্রী
সেলিনার কথা, ‘গ্রন্থাগারটি আমাদের আরেক সন্তান। সন্তানকে উপযুক্ত পরিবেশে
মর্যাদার সঙ্গে বাঁচিয়ে রাখা বাবা-মায়ের কর্তব্য। আমরা সেটা পালন করছি।’
কিন্তু
এখনো যে অনেক কাজ বাকি। দেশের আনাচ-কানাচে উচ্চারিত হবে দর্শনার এই
গ্রন্থাগারের নাম। এই স্বপ্ন দেখেন আবু সুফিয়ান। বললেন, ‘নিজস্ব জমিতে একটি
ভবন ও গ্রন্থাগারটিকে তথ্যপ্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করার ইচ্ছা রয়েছে। কিন্তু
অর্থাভাবে তা হচ্ছে না।’
কেউ কি শুনতে পেলেন কথাটি?
No comments:
Post a Comment